এনজিওসহ কিছু সংস্থা চায় না রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আকস্মিক খবরে প্রশাসন যেমন বিচলিত, তেমনি হকচকিত হয়ে পড়েছে রোহিঙ্গারাও। কেননা মিয়ানমার এমন সময় প্রত্যাবাসনের দিনক্ষণ ঘোষণা করেছে, যখন বাংলাদেশে ঈদ ও সাপ্তাহিক ছুটি চলছে।

এমনকি যে চারটি শিবিরের তিন হাজার ৫৪০ জন রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সম্মতি জানিয়েছে সেই শিবিরগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তারাও গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত কর্মস্থলে ফেরেননি। এ ছাড়া প্রতাবাসনের জন্য মিয়ানমারের দেওয়া ছাড়পত্রও শিবিরগুলোতে পৌঁছেনি।
এমন অবস্থায় আগামী ২২ আগস্ট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করা যাবে কি না তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছে না। তবে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা বলেছেন, তাঁরা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনকাজের জন্য সব সময়ই প্রস্তুত আছেন। এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারের ছাড়পত্রধারী রোহিঙ্গাদের মতামতই এখন মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গারা বলছে, রাখাইনে এখনো ফিরে যাওয়ার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করেনি মিয়ানমার।

কক্সবাজারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকাজ তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারের অতিরিক্ত সচিব এবং শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ আবুল কালাম আগামী ২২ আগস্ট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দিন ধার্য হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। গতকাল শুক্রবার তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মিয়ানমার তিন হাজার ৫৪০ জন রোহিঙ্গাকে এ দফায় ফিরিয়ে নিতে সম্মতির কথা জানিয়েছে। আমরা যেকোনো সময় প্রত্যাবাসনের জন্য প্রস্তুত রয়েছি।

কিন্তু যাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য মিয়ানমার ছাড়পত্র দিচ্ছে সেই রোহিঙ্গারা ফিরছে কি না সেটাই দেখার বিষয়। ’
আরআরআরসি বলেন, তিনি এরই মধ্যে রোহিঙ্গা শিবিরের ছুটিতে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের জরুরি ভিত্তিতে কর্মস্থলে ফিরতে নির্দেশনা দিয়েছেন। মিয়ানমারের ছাড়পত্র দেওয়া তালিকা নিয়ে রোহিঙ্গাদের শনাক্ত করার কাজও শুরু হবে।

অন্যদিকে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘বিদেশি বার্তা সংস্থার খবর পড়েই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে প্রথমে জানতে পেরেছি। তবে কারা বা কে এমন দিন ধার্য করেছে তা সংবাদে উল্লেখ নেই। ’ জেলা প্রশাসক জানান, দিনক্ষণ ধার্য হওয়ায় আগামীকাল রবিবার কক্সবাজারে প্রত্যাবাসনসংক্রান্ত জরুরি সভা ডাকা হয়েছে।

গত বছরের ১৫ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা ছিল। অভিযোগ আছে, সেবারও মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ এ রকম তড়িঘড়ি করে দিন নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু মিয়ানমারে ফেরার পরিবেশ না থাকায় রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে রাজি হয়নি। এ কারণে প্রত্যাবাসন শুরু করার উদ্যোগ ভেস্তে যায়।

এবারও ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা ঢলের বার্ষিকী এবং আগামী মাসে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে শীর্ষ সম্মেলনের প্রাক্কালে মিয়ানমার তড়িঘড়ি করে প্রত্যাবাসনে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। অথচ রোহিঙ্গাদের ফেরার পরিবেশ সৃষ্টির ব্যাপারে তাদের আগ্রহ নেই।

গতকাল খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রোহিঙ্গা শিবিরে প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তাই উপস্থিত নেই। উখিয়ার ইউএনও মো. নিকারুজ্জামান এ বিষয়ে বলেন, ‘আমার উপজেলায় সাত থেকে আট লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। অথচ আমিই জানলাম না প্রত্যাবাসনের দিনক্ষণ। একটি বিদেশি বার্তা সংস্থার খবরে প্রত্যাবাসন শুরুর তারিখ দেখে আমি নিজেই হতবাক হয়েছি। ’ তিনি জানান, শিবিরগুলোর সব সরকারি কর্মকর্তা যে সময় ঈদের ছুটিতে সেই সময় আকস্মিক প্রত্যাবাসনের ঘোষণায় আবারও নানা সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। এলাকার অনেক লোক তাঁকে এবারও প্রত্যাবাসনের ঘোষণা নিয়ে সন্দেহের কথা জানিয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে, আরেক দফা প্রত্যাবাসনের কাজও যাতে ভণ্ডুল হয়ে যায় সে জন্য গোপনে তৎপরতা চলছে। একদিকে দেশি-বিদেশি এনজিওগুলো যেমন তৎপর, তেমনি তৎপর রোহিঙ্গা শিবিরের ভেতর প্রত্যাবাসনবিরোধী গোষ্ঠী। এনজিওগুলোর ভূমিকা নিয়েও নানা অভিযোগ আছে।

কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ সীমান্ত এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশি-বিদেশি

এনজিওসহ কিছু সংস্থার লোকজন কোনোভাবেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চায় না। এ প্রসঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ও কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, ‘ঈদুল আজহা এবং জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে শিবিরগুলোর চিকিৎসা ক্যাম্প ছাড়া সব কার্যক্রম বন্ধ রাখার কথা। কিন্তু কি উদ্দেশ্যে বেশ কটি এনজিও বন্ধের সময় শিবিরগুলোতে তৎপর ছিল তা তদন্ত করা দরকার। ’

আরআরআরসি মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, ‘আগামী ২২ আগস্টের প্রত্যাবাসন সফল করার কাজ করার উদ্দেশ্য নিয়েই আমি এসব সংস্থা এবং এনজিওগুলোকে কাজ করতে অনুমতি দিয়েছিলাম। তবে তারা প্রত্যাবাসনবিরোধী কাজ করছে কি না সে রকম আমার জানা নেই। ’

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির অন্যতম নেতা উখিয়ার নুর মোহাম্মদ সিকদার অভিযোগ করেছেন, যখনই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের তোড়জোড় শুরু হয় তখনই সমানতালে প্রত্যাবাসনবিরোধী অপতৎপরতা চলে। প্রত্যাবাসনবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ও কিছু এনজিও শিবিরের ভেতর ‘আল ইয়াকিন’ নামে পরিচিত কিছু উগ্র রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে উসকানি দিয়ে আসছে। এসব উসকানিতে আল ইয়াকিন নামের উগ্রবাদী রোহিঙ্গারা গত কদিন ধরেই শিবিরগুলোতে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সন্ধ্যার পরপরই আবারও নেমে পড়ে। তারা দেশে ফিরতে ইচ্ছুক সাধারণ রোহিঙ্গাদের হুমকি প্রদর্শন করে আসছে।

টেকনাফের ২৪ নম্বর শিবিরের (শালবাগান) রোহিঙ্গা নেতা জাফর আহমদ বলেন, জাতিসংঘে আসন্ন বৈঠকে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশকে দোষারোপ করার জন্যই আকস্মিক একটি দিন ধার্য করেছে।

জাদিমুরার ২৭ নম্বর শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা আইউব মাঝি বলেন, ‘মিয়ানমারের পররাষ্ট্রসচিবের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল সবেমাত্র রোহিঙ্গা শিবির ঘুরে গেছে। সে সময় মিয়ানমারের সঙ্গে আরো আলোচনার প্রস্তাব দেওয়া হলে তারা (মিয়ানমার প্রতিনিধিদল) রাজি হয়। কিন্তু সেই আলোচনার আগেই হঠাৎ প্রত্যাবাসনের দিন-তারিখ ঘোষণা করার অর্থ হলো—মিয়ানমারের উদ্দেশ্য ভালো নয়। কালেরকন্ঠ